প্রসঙ্গ: শবে বরাত : আক্বীদা, আমল ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা (একটি দলীল ভিত্তিক আর্টিকেল-৬)
শবে বরাত কি? শবে বরাত-এর অর্থ কি? অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী সহযোগে শরীয়তে কোনো নাম হতে পারে কি-না? শবে বরাত সম্পর্কে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি-না?
“শবে বরাত ও তার অর্থ:
এর জাওয়াব হলো, ‘শবে বরাত’ হচ্ছে ইসলামের বিশেষ রাত্রিসমূহের মধ্যে একটি রাত্র। যা শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত্রিতে হয়ে থাকে।
‘শব’ ফারসী শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে “রাত্র।” আর “বরাত” আরবী শব্দ যা উর্দূ, ফারসী, বাংলা ইত্যাদি সব ভাষাতেই ব্যবহার হয়ে থাকে। যার অর্থ ‘মুক্তি ও নাযাত। একত্রে ‘শবে বরাত’-এর অর্থ হচ্ছে ‘মুক্তির রাত্র’ বা “নাজাতের রাত্র।” কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এর ভাষা যেহেতু আরবী তাই ফারসী “শব” শব্দটি কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ না থাকাটাই স্বাভাবিক।
“অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী সহযোগে শরীয়তে কোনো নাম হতে পারে কি-না?”
এর জাওয়াব হলো, হ্যাঁ, অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী সহযোগে শরীয়তে নাম অবশ্যই হতে পারে। এ ব্যাপারে শরীয়তে কোনরূপ বাধা-নিষেধ নেই।
সুতরাং যা শরীয়তে নিষেধ নয় তা নিষেধ বলে প্রচার করা শরীয়তের মধ্যে ইফরাত-তাফরীত তথা বাড়ানো-কমানোর শামিল, যা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
‘অর্ধেক ফারসী আর অর্ধেক আরবী সহযোগে কোনো নাম শরীয়তে হতে পারে না,’ এ বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে শরীয়তের খিলাফ। এ বক্তব্যকে কেউ শরীয়তসম্মত প্রমাণ করতে চাইলে তবে তাকে অবশ্যই শরীয়তের দলীল পেশ করতে হবে। অন্যথায় তার বক্তব্য বা দাবি আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-
هاتوا برهانكم ان كنتم صدقين.
অর্থ: “যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক তাহলে দলীল পেশ কর।” (সূরা বাক্বারা : আয়াত শরীফ ১১১)
অর্থাৎ দলীল-প্রমাণ ছাড়া কারো কোনো কথা গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রকাশ থাকে যে, পৃথিবীতে যত ভাষা রয়েছে তন্মধ্যে একমাত্র আরবী ভাষাই স্বয়ং সম্পূর্ণ। এছাড়া অন্যান্য প্রতিটি ভাষাই একটি আরেকটির পরিপূরক। আর কোনো ভাষাই শরীয়তের খিলাফ নয়। বরং প্রতিটি ভাষাই শরীয়তসম্মত। যেমন এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-
وما ارسلنا من رسول الا بلسان قومه ليبين لهم
অর্থ: “আমি প্রত্যেক নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকেই উনাদের নিজ নিজ ক্বওমের ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি; যাতে তাদেরকে স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারেন।” (সূরা ইবরাহীম : আয়াত শরীফ ৪)
ومن ايته خلق السموت والارض واختلاف السنتكم والوانكم ان فى ذلك لايت للعلمين.
অর্থ: “উনার (আল্লাহ পাক উনার) আরো এক নিদর্শন হচ্ছে যে, আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয়ই এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (সূরা রূম : আয়াত শরীফ ২২)
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
خلق الانسان علمه البيان
অর্থ: “তিনি (আল্লাহ পাক) সৃষ্টি করেছেন মানবকে এবং তাঁকে বয়ান বা বর্ণনা শিক্ষা দিয়েছেন।” (সূরা আর রহমান : আয়াত শরীফ-৩, ৪)
সূরা আর রহমানের এ আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় বিশ্বখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থ “তাফসীরে মাযহারীতে” উল্লেখ রয়েছে-
فكان حضرت ادم عليه السلام يتكلم بسبع مأة الف لغة
অর্থ: “হযরত আদম আলাইহিস সালাম তিনি সাত লক্ষ ভাষায় কথা বলতে পারতেন।”
তবে সর্বাধিক উত্তম ও শ্রেষ্ঠ ভাষা হচ্ছে আরবী। এরপর হচ্ছে ফারসী। যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আরবী ভাষার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এ কারণে আরবী ভাষার সাথে ফারসী ভাষা মিশ্রিত হয়ে বহু শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন, গুম্বাদে খাদ্বরা (সবুজ গুম্বুজ), মাহে রমাদ্বান (রমযান মাস), শবে ক্বদর (ক্বদরের রাত), শবে মি’রাজ (মি’রাজের রাত), আবে যমযম (যমযমের কূপের পানি), কোহে তূর (তুর পর্বত), সিকান্দার যুল ক্বারনাইন, আলমগীর ইত্যাদি।
উপরোক্ত উদাহরণে গুম্বাদে, মাহে, শবে, আবে, কোহে, সিকান্দার ও গীর শব্দসমূহ ফারসী ভাষার শব্দ যা যথাক্রমে আরবী শব্দ খাদ্বরা, রমাদ্বান, ক্বদর, মি’রাজ, যমযম, তূর, যুল ক্বারনাইন ও আলম শব্দের সাথে বা সহযোগে ব্যবহৃত হয়েছে এবং নাম হিসেবেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
উল্লেখ্য, এক ভাষায় অপর ভাষার শব্দের মিশ্রণ মূলত একটি অনিবার্য ঐতিহ্য। প্রায় সব ভাষায়ই এর নিদর্শন রয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষায়ও এর নিদর্শন অনেক। এবং এটি প্রায় সব ভাষারই প্রকৃতি। ব্যাকরণের ভাষায় একে বলা হয় মিশ্র শব্দ। প্রতি ভাষায়ই মিশ্র শব্দের ব্যবহার রয়েছে।
কাজেই যারা বলবে যে, অর্ধেক আরবী আর অর্ধেক ফারসী ভাষার শব্দের মিশ্রণ গ্রহণযোগ্য নয় তারা মূলত শুধু ইসলাম সম্পর্কেই অজ্ঞ নয়। বরং দুনিয়াবী জ্ঞানের দিক থেকেও তারা প্রাইমারি স্তরের জ্ঞানও রাখে না। অতএব প্রমাণিত হল যে, যারা ইহু*দী ও নাছা*রাদের দোসর আল্লাহ পাক উনার এবং উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দুশমন কেবলমাত্র তারাই দলীল আদিল্লাহ ছাড়াই লাগামহীন, মনগড়া, বানোয়াট, ভিত্তিহীনভাবে অর্ধ শা’বানের রাত, বরকতপূর্ণ রাত এই শবে বরাতকে অস্বীকার করে গোমরাহী ও কুফরীমূলক বক্তব্য পেশ করে থাকে।
“শবে বরাত সম্পর্কে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে কোনো তথ্য পাওয়া যায় কি-না?”
এর সঠিক জবাব হলো, হ্যাঁ, শবে বরাত সম্পর্কে কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ অবশ্যই তথ্য বা বর্ণনা রয়েছে। কুরআন শরীফ-এর ভাষায় “শবে বরাতকে” “লাইলাতুম মুবারাকাহ বা বরকতময় রজনী” এবং হাদীছ শরীফ-এর ভাষায় শবে বরাতকে “লাইলাতুন নিছফি মিন শা’বান” বা শা’বানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত্রি” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন যে
انا انزلنه فى ليلة مبركة انا كنا منذرين فيها يفرق كل امر حكيم. امرا من عندنا انا كنا مرسلين.
অর্থ: “নিশ্চয়ই আমি বরকতময় রজনীতে (শবে বরাতে) কুরআন নাযিল করেছি। আর আমিই ভয় প্রদর্শনকারী। উক্ত রাত্রিতে আমার পক্ষ থেকে সমস্ত প্রজ্ঞাময় কাজগুলো ফায়সালা করা হয়। আর নিশ্চয়ই আমিই প্রেরণকারী।” (সূরা দুখান : আয়াত শরীফ ৩-৫)
এ আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় হযরত মুফাসসিরীনে কিরাম বিশেষ করে রঈসুল মুফাসসিরীন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন-
قد اخبر الله سجانه عن هذه الليلة المباركة التى هى ليلة النصف من شعبان انه تعالى يفرق فيها كل امر من اموره المحكمة.
অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘লাইলাতুম্ মুবারাকাহ্ অর্থাৎ বরকতময় রাত্রি বলতে শা’বান মাসের মধ্য রাত অর্থাৎ শবে বরাতকে বুঝিয়েছেন। আল্লাহ পাক তিনি এ রাতে সকল প্রজ্ঞাসম্পন্ন বিষয়ের ফায়সালা করে থাকেন।” (ছফওয়াতুত্ তাফাসীর)
চলবে---------
Post a Comment