প্রসঙ্গ: শবে বরাত : আক্বীদা, আমল ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা (একটি দলীল ভিত্তিক আর্টিকেল-৩)

শবে বরাত কি


ওই রাত্রিগুলোর মধ্যে কোনো এক রাত্রি ছিল নবীজি পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে আমার হিসসা। অতঃপর তিনি আগমন করলেন এবং আমার সাথেই শয্যা গ্রহণ করলেন। কিন্তু রাত্রিতে এক সময় সজাগ হয়ে আমি উনাকে বিছানা মুবারক-এ অনুপস্থিত পেলাম এবং মনে মনে ভাবলাম তাহলে কি তিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত মারিয়া কিবতিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার কাছে চলে গেলেন! অতঃপর উনাকে মসজিদে নববীর উদ্দেশ্যে খোঁজার জন্য মনস্থ করে উঠে চলতে শুরু করলাম। হঠাৎ আমার শরীর মুবারক-এর অংশ নবীজি পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্রতম শরীর মুবারক-এ স্পর্শ করলো। তখন লক্ষ্য করে শুনি তিনি একাগ্র মনে বলছেন

سجدلك سوادى وخيالى وامن بك فؤادى وهذه يوى وما جنبت بها على نفسى يا عظيما يرجى لكل عظيم اغفر الذنب العظيم سجد وجهى للذى خلقه وصوره وشق سمعه وبصره.

আয় আল্লাহ পাক! সর্বান্তকরণে আমার দেহ মুবারক, আমার মুখমন্ডল মুবারক এবং সমস্ত কিছুই আপনার জন্য সিজদাবনত। আমার অন্তঃকরণ মুবারক আপনার প্রতি ঈমান এনেছে। এই যে আমার হাত মুবারক সেও আপনার প্রতি বিশ্বাসী। এ হাত ও অন্যান্য আর যা কিছু দিয়ে আমি করি তা মাফ করুন। হে মহান, মহা অপরাধের ক্ষমার জন্য যার মহা অনুগ্রহের আশা করা হয় আমার তথা (উম্মতের) বড় বড় গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিন। আমার মুখম-ল মুবারককে, আমাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, আকৃতি মুবারক দিয়েছেন, কর্ণ মুবারক ও শ্রবণ শক্তি মুবারক, চক্ষু মুবারক ও দৃষ্টি শক্তি মুবারক যিনি দান করেছেন, আমাকে ক্ষমা করুন।

اللهم ارزقنى قلبا تقيا نقيا من الشرك بريا لا كافرا ولا شقيا.

আয় আল্লাহ পাক! আপনার ভয়ে শিরক থেকে পবিত্র, গুনাহ থেকে স্বচ্ছ অন্তঃকরণ মুবারক দান করুন যার মধ্যে কুফুরের লেশমাত্র না থাকে, যে অন্তর কোনো দিন বঞ্চিত ও দুর্ভাগা না হয়।

اعوذ برضاك من سخطك وبعفوك من عقوبتك وبك منك لا احصى ثناء عليك انت كما اثنيت على نفسك اقول كما قال اخى داود اعفر وجهى فى التراب لسيدى وحق لوجه سيدى ان يعفر.

আয় আল্লাহ পাক! আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমেই আপনার রোষ ও অসন্তুষ্টি থেকে পানাহ চাই। আপনার ক্ষমার মাধ্যমেই আপনার আযাব ও গযব হতে পানাহ চাই। আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমেই আপনার থেকে পানাহ চাই। হে আল্লাহ পাক! আপনার প্রশংসা করে শেষ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি তো তেমনি যেমন আপনি নিজের প্রশংসা করেছেন। আমি তাই বলি যা আমার ভাই হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম তিনি বলেছেন, আমি আমার প্রভুর জন্য আমার চেহারা মুবারক মাটিতে স্থাপন করি। এতে আমি উনার ক্ষমা অবশ্যই পেতে পারি।

অতঃপর তিনি মাথা মুবারক উত্তোলন করলেন। আমি আরয করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার উপর আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক আপনি কি করছেন আর আমি কি ভাবছি! তখন নবীজি পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হে হুমায়রাহ অর্থাৎ হে উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা! আপনি কি জানেন না? আজকের এই রাত্রি হচ্ছে অর্ধ শা’বানের রাত্রি তথা শবে বরাতের রাত্রি। এই রাত্রিতে মহান আল্লাহ পাক তিনি বনী কালব গোত্রের অসংখ্য বকরীর পশমের পরিমাণ লোককে দোযখ থেকে পরিত্রাণ ও মুক্তি দান করেন। 

তবে ছয় শ্রেণীর লোককে ক্ষমা করেন না।

১. মদ্যপায়ী

২. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান

৩. ব্যভিচারী

৪. সম্পর্ক ছিন্নকারী

৫. ফিতনাবাজ

৬. চোগলখোর।

এক বর্ণনায় ফিতনাবাজ স্থলে প্রাণীর ছবি অঙ্কণকারীর কথা উল্লেখ আছে। অর্ধ শা’বানের রাত্রিকে ক্বিসমত ও তাক্বদীর তথা ভাগ্য নির্ধারণের রাত বা শবে বরাত বলা হয়।

হযরত আতা ইবনে ইয়াসার রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেন, এক শা’বান থেকে পরবর্তী শা’বান পর্যন্ত যারা মৃত্যুবরণ করবে তাদের নামের তালিকাও লিখিত হয় এই অর্ধ শা’বানের রাতে তথা শবে বরাতে। অতঃপর সেই তালিকা ফেরেশতাদের হাতে হস্তান্তর করা হয়। অথচ এই সময়ে তাদের কেউ কেউ ক্ষেত-খামারে কাজ করতে থাকে, কেউ কেউ বিবাহ করতে থাকেন, কেউ কেউ অট্টালিকা তৈরিতে মত্ত থাকেন, এদিকে মালাকুল মউত অপেক্ষায় থাকে যে, আল্লাহ পাক উনার হুকুম হওয়া মাত্রই তৎক্ষণাৎ তার জীবন কবয করে নিবেন।

বিঃ দ্রঃ (উপরোক্ত হাদীছ শরীফ-এ নবীজি পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে যে ক্ষমা ও দোয়া প্রার্থনা করেছেন তা মূলত উনার উম্মতের জন্য। কেননা আক্বাইদ এবং ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবের মধ্যে রয়েছে, সমস্ত ইমাম মুজতাহিদ উনারা একমত হয়েছেন যে-

الانبياء عليهم السلام كلهم معصومون


(সকল নবী ও রসূল আলাইহিমুস সালামগণ উনারা মাছুম তথা নিষ্পাপ। তাদের ক্ষমা চাওয়ার অর্থই হচ্ছে উম্মতের গুনাহসমূহ ক্ষমা চাওয়া এবং উম্মতদেরকে তা’লীম দেয়ার জন্য।

উপরোক্ত হাদীছ শরীফ ছাড়াও হাদীছ শরীফ-এ আরো উল্লেখ আছে যে, চার অথবা পাঁচ রাত্রিতে মহান আল্লাহ পাক তিনি বান্দাদেরকে বিশেষভাবে ক্ষমা করে দোয়া কবুল করে থাকেন। তন্মধ্যে অর্ধ শা’বান রাত তথা শবে বরাত একটি অন্যতম দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ রাত্রি।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত হাদীছ শরীফ-এর কিতাব দাইলামী শরীফ-এ বর্ণিত আছে যা ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত তরীক্বত হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সুবিখ্যাত কিতাব মুকাশাফাতুল কুলুব-এর ৩০২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-

روى الديلمى عن ام المؤمنين حضرت عائشة عليها السلام قالت سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول (يسح الله الخير فى أربع ليال، سحا ليلة الاضحى وليلة الفطر، وليلة النصف من شعبان، واول ليلة من رجب)

وروى الديلمى ايضا بسنده عن ابى امامة عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال خمس ليال لاترد فيها دعوة، أول ليلة من رجب وليلة النصف من شعبان وليلة الجمعة وليلتا العيدين

অর্থ: শাইখুল ইসলাম হযরত ইমাম দাইলামী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার সূত্রে বর্ণনা করেন। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনি বলেন, নবীজি পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি চারটি রাতে প্রচুর পরিমাণে রহমত নাযিল করেন:

এক. ঈদুল আযহার রাতে।

দুই. ঈদুল ফিতরের রাতে।

তিন. অর্ধ শা’বানের রাতে তথা শবে বরাতে।

চার. রজব মাসের পহেলা রাতে।


হযরত ইমাম দাইলামী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত উমামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সূত্রে আরো হাদীছ বর্ণনা করেন। হযরত উমামা রদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নবীজি পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, ‘পাঁচটি রাত’ এমন রয়েছে যেগুলোতে কেউ দোয়া করলে তা ফিরিয়ে দেয়া হয় না।

এক. রজব মাসের প্রথম রাত।

দুই. অর্ধ শা’বান তথা বরাতের রাত।

তিন. জুমুয়ার রাত।

চার ও পাঁচ. দুই ঈদের রাত। 

অর্থাৎ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত। (নুযহাতুল মাজালিশ ১ম খ- ১৫৭ পৃষ্ঠা)



চলবে----------

৪থ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন 


1 Comments

Post a Comment

Previous Post Next Post