পবিত্র মাহে রমজানের আদব ও সুন্নত সমূহ 

রোজার সুন্নত সমূহ




প্রত্যেক ইবাদতেরই কিছু আদব কায়দা ও শিষ্টাচার রয়েছে। রোজা পালনের কিছু মুস্তাহাব বা সুন্নাত আদব আছে যেগুলো পালন করলে সাওয়াব বেড়ে যাবে। আর তা ছেড়ে দিলে রোজা ভঙ্গ হবে না বা গোনাহও হবে না। তবে পুণ্যে ঘাটতি হবে। কিন্তু তা আদায় করলে সওয়াবের পরিপূর্ণতা আসে। নিম্নে এসব আদব উল্লেখ করা হলো

আরও পড়ুনঃ- স্বামী কে খুশি করার টিপস 

১. সাহরি খাওয়া : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “তোমরা সাহরি খাও, কারণ সাহরিতে বরকত রয়েছে। (বুখারী, হাদিস নং-১৯২৩; মুসলিম, হাদিস নং-১০৯৫) অপর এক

হাদিসের বর্ণনায় এসেছে, “আমাদের (মুসলিমদের) ও ইয়াহুদী-

নাসারাদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। (মুসলিম,

হাদিস নং-১০৯৬) আমরা রোজা পালন করি সাহরি খেয়ে, আর

ইয়াহুদী-নাসারারা রোজা রাখে সাহরি না খেয়ে। রাসূল সা. বলেন,

মু’মিনের সাহরিতে উত্তম খাবার হলো খেজুর। (আবু দাউদ, হাদিস নং-২৩৪৫) রাসূল সা. বলেন, (রোজাদারদের জন্য) সাহরি হলো একটি বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরি খাওয়া বাদ দিও না। এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরি খেয়ে নাও। কেননা সাহরির খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তাআলা ও তার ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন। (আহামদ, হাদিস নং-১০৭০২)

আরও পড়ুনঃ- স্ত্রীর প্রতি স্বামীর হক 

২. সাহরি দেরি করে খাওয়া : রোজার অপর একটি সুন্নাত

আদব হলো সাহরি দেরি করে খাওয়া। অর্থাৎ তা শেষ ওয়াক্তে

খাওয়া উত্তম। রাতের শেষাংশে গ্রহণকৃত খাবারকে সাহরি বলা হয়।


৩.সাহরির সময়কে ইবাদতে কাজে লাগানো : প্রতিরাতের শেষ

তৃতীয়াংশ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আরশ থেকে প্রথম

আসমানে নেমে আসেন। আর বান্দাদের এই বলে আহ্বান করেন : ‘এখন যে ব্যক্তি আমার কাছে দু’আ করবে আমি তা কবুল করব, যা কিছু আমার কাছে এখন চাইবে আমি

তাকে তা দিব এবং যে আমার কাছে এখন মাফ চাইবে আমি

তাকে মাফ করে দিব। (বুখারী, হাদিস নং-৬৩২১; মুসলিম, হাদিস

নং-৭৫৮) অতএব তখন কুরআন অধ্যয়ন, তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদের সালাত আদায়, তাওবাহ-ইস্তিগফার ও দু’আ

কবুলের জন্য এটা এক উত্তম সময়। তাদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন- ‘তারা শেষ রাতে জেগে উঠে তাওবাহ-ইস্তিগফার করে।’ (সূরাহ যারিয়াত, আয়াত-১৮)


 ৪. সূর্য অস্ত যাওয়া মাত্র ইফতার করা অর্থাৎ তাড়াতাড়ি ইফতার করা : অতিরঞ্জিত সাবধানতার নামে ইফতার বিলম্ব না করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘মানুষ যতদিন পর্যন্ত তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে। (বুখারী, হাদিস নং-১৯৫৭; মুসলিম, হাদিস নং-১০৯৮) অন্য এক

হাদিসে এসেছে, যতদিন মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন

দীন ইসলাম বিজয়ী থাকবে। কেননা, ইয়াহুদী ও নাসারাদের

অভ্যাস হলো ইফাতর দেরিতে করা। (বুখারী, হাদিস নং-১৯৫৭; মুসলিম, হাদিস নং-১০৯৮) অপর এক হাদিসে এসেছে, তিনটি বিষয় নবী চরিত্রের অংশ : সময় হওয়া মাত্র ইফতার করে ফেলা, সাহরি শেষ ওয়াক্তে খাওয়া এবং সালাতে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদিস নং-১০৫)অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীগণ সকলের আগে তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন এবং সকলের চেয়েদেরিতে সাহরি খেতেন। (মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদিস নং-৭৫৯১)


৫. মাগরিবের সালাতের পূর্বে ইফতার করা এবং খেজুর বা

পানি দ্বারা ইফতার করা : এ প্রসঙ্গে হাদিসের এক বর্ণনায়

এসেছে, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (মাগরিবের)

সালাতের পূর্বে তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি তাজা

খেজুর পাওয়া না যেত তবে শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। আর যদি শুকনা খেজুর পাওয়া না যেত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন। (আহমাদ, হাদীস নং-৩ খ-, পৃ. ১৬৪) তবে পেট ভর্তি করে খাওয়া ইসলাম সমর্থন করে না।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি

পেট ভর্তি করে খানা খায় তার ঐ পেট (আল্লাহর কাছে) একটি

নিকৃষ্ট পাত্র।’ (আহমাদ, হাদিস নং-৩ খ-, পৃ. ১৬৪)সুন্নাত হলো পেটের তিন ভাগের একভাগ খাবার খাবে, আর তিনভাগের একভাগ পানি পান করবে। বাকি এক তৃতীয়াংশ শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য খালি রেখে দিবে। (তিরমিযী, হাদিস নং-২৩৮০)


৬. ইফতারের সময় দু’আ করা : এ মুহূর্তটি জাহান্নাম থেকে মুক্তি

দেয়ার সময়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ইফতারের সময় আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন বহু

লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। আর এ মুক্তি দানের

পালা রমাজানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে। সে সময় রোজা

পালনকারী প্রত্যেক বান্দার দু’আ কবুল হয়।’ (আহমাদ, হাদিস নং-৭৪৫০) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন, হে আল্লাহ! তোমার জন্য রোজা রেখেছি, আর তোমারই রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।


৭. বেশি বেশি কুরআন পাঠ করা, সালাত আদায়, যিকর ও দু’আ করা : রমজান যেহেতু কুরআন নাযিলের মাস সেহেতু এ মাসে কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন অন্য সময়ের চেয়ে বেশি করা উচিত। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ বলেছেন : রোজা ও

কুরআন কিয়ামতের দিন (আল্লাহর কাছে) মানুষের জন্য এভাবে

সুপারিশ করবে যে, রোজা বলবে, হে রব! দিনের বেলায় আমি তাকে পানাহার ও যৌন উপভোগ থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার

ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর।কুরআনও বলবে, হে রব! (রাতে কুরআন পাঠের কারণে) রাতের নিদ্রা থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই এ পাঠকের ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ মঞ্জুর কর। তিনি বলেন : অতঃপর উভয়েরই সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (আহমাদ, হাদিস নং-৬৫৮৯)


৮.ইবাদতের তাওফীক কামনা ও আল্লাহর দয়া অনুধাবন করা : আমরা যে ইবাদত করি তাও আল্লাহর দয়া। তিনি যে এ কাজে আমাদের তাওফীক দিয়েছেন সেজন্য আমরা তার শুকরিয়া আদায় করি। অনেকের ভালো কাজও আবার কবুল হয় না।

আল্ল¬াহ বলেন, ‘কেবলমাত্র মুত্তাকীদের কাজই আল্লাহ কবুল

করেন। (মায়িদাহ, হাদীস নং-২৭) ভয় ও আশা নিয়ে যেন আমরা ইবাদত করি। গর্ব-অহঙ্কার ও হিংসা বান্দার ইবাদতকে নষ্ট করে দেয় এবং কুফরি ও শির্ক করলে তার কোন নেকিই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং ইবাদতসমূহ ধ্বংস ও বাতিল হয়ে যায়।


৯. ইয়াতিম, বিধবা ও গরিব মিসকিনদের প্রতি সহানুভূতিশীল

হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা : তাদের যাকাত, ফিত্রা ও সাদাকাহ দেয়া। হাদিসে এসেছে : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু

আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি

দানশীল আর রমাজানে তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত।

(মুসলিম, হাদিস নং-২৩০৮)


১০. উত্তম চরিত্র গঠনের অনুশীলন করা : রমজান ধৈর্যধারণের মাস। আর রোজা হলো এ কার্য প্রশিক্ষণের ইনস্টিটিউট।

কাজেই এ সময় আমাদের সুন্দর চরিত্র গঠনের অনুশীলন করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের

মধ্যে কেউ যদি রোজা রাখে, সে যেন তখন অশ্লীল কাজ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। রোজা রাখা অবস্থায় কেউ যদি তার সাথে গালাগালি ও মারামারি করতে আসে সে যেন বলে, ‘আমি রোজাদার’। (মুসলিম, হাদিস নং-১১৫১)


১১. অপচয় ও অযথা খরচ থেকে বিরত থাকা : খাওয়া-

দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আরাম আয়েশে অনেকেই অপচয় ও অপব্যয় করে থাকে। এটা এক গর্হিত কাজ। এ থেকে বিরত থাকা।


১২. রুটিন করে সময়টাকে কাজে লাগানো : অহেতুক কথাবার্তা, আড্ডা বাজি, গল্প-গুজব, বেহুদা তর্কবিতর্ক পরিহার

করা। রুটিন করে পরিকল্পনা ভিত্তিক কাজ করা। এতে জীবন

অধিকতর ফলপ্রসূ হবে।


১৩. দুনিয়াবী ব্যস্ততা কমিয়ে দেয়া : রমাজানের এ বরকতময় মাসে অর্থ উপার্জন ও ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যস্ততা কমিয়ে দিয়ে আখিরাতের মুনাফা অর্জনের জন্য অধিকতর বেশি সময় দেয়া আবশ্যক। দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর আখিরাত চিরস্থায়ী। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আর আখিরাতের জীবন সর্বোত্তম এবং চিরস্থায়ী।’ (সূরা আ’লা, হাদিস নং-১৭)


১৪. খাওয়া ও নিদ্রায় ভারসাম্য রক্ষা করা : কেউ কেউ এতো বেশি খাবার খায় যে নাস্তা ও দুপুরের খাবার শুধু ইফাতের

এক বেলায়ই তা পুষিয়ে নেয়। আবার তারাবীহ ও সেহরির

ওয়াক্তের দ্বিগুণ দিনের বেলায় ঘুমিয়ে তা কাযা করে। এভাবে

চললে খাবার ও ঘুমের কুরবানী হলো কীভাবে? তাই এ বিষয়ে

রোজাদারকে ত্যাগতীতিক্ষা করতে হবে এবং এ দু’এর মধ্যে

ভারসাম্য বজায় রেখে রোজা পালন করে যেতে হবে।


১৫. ফজর উদয় হওয়ার পূর্বেই রোজার নিয়ত করা।


১৬. আল্ল¬াহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা।


১৭. রমাজানের পবিত্র দিন ও রাতগুলোতে ইবাদত করার

তাওফিক দেয়ায় মাবুদের প্রশংসা করা।


১৮. হাত, পা, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও অন্তঃকরণ দ্বারা সিয়াম বা রোজা পালন করা।


১৯. সর্বদা নেক কাজ করা।


২০. রোজা অবস্থায় দোয়া, দরুদ, তাসবীহ্-তাহলীল ও কোরআন

তিলাওয়াতে লিপ্ত থাকা।


২১. বেশী বেশী দান খয়রাত করা।


২২. সময় হওয়ার সাথে সাথে কাল বিলম্ব না করে ইফাতার করা।


২৩. রমজানের রাত সমূহ তারাবীহের নামায আদায় করা।


২৪. সমগ্র রমজানে তারাবীহের নামাযে সমস্ত কুরআন শরীফ

তিলাওয়াত করা বা শ্রবণ করা।


২৫. রমজান মাসে শেষ দশকে ই'তিকাফ করা।


Post a Comment

Previous Post Next Post